হাওরে এখন ভরা বর্ষা। যেদিকে চোখ যায়, শুধু থই থই পানি। বর্ষায় জলে-ঢেউয়ে মানুষের জীবন মিলেমিশে একাকার। আর্থসামাজিক কারণে হাওরে মানুষের জীবনে নানাভাবে পরিবর্তন এসেছে সত্য। তবে ‘বর্ষায় নাও (নৌকা) এবং হেমন্তে পাও (পা)’ কথাটা কিন্তু এখনো রয়ে গেছে। বর্ষায় নৌকা ছাড়া চলে না হাওরের লোকজনের।
বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের ‘রংবেরঙের’ কত নৌকা চলে হাওরে। শখের ‘ময়ূরপঙ্খি নাও’, ‘নাইওরি নাও’ তো আছেই, এর সঙ্গে মানুষের যাতায়াত ও জীবিকার তাগিদে হাওরে মাছ ধরা—সব কাজেই নৌকা লাগে এই সময়। তাই বর্ষাজুড়ে হাওর এলাকায় জমজমাট থাকে নৌকার হাট। জেলার সব উপজেলাতেই কমবেশি নৌকার হাট বসে। এর মধ্যে জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, দিরাই, শাল্লা ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় নৌকা লাগে অন্য উপজেলার চেয়ে বেশি। তাই এসব উপজেলায় নৌকার হাটও বেশি বসে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাটে ছোট নৌকাই বেশি বিক্রি হয়। এসব নৌকা হাওরে মাছ ধরা, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাতায়াতে ব্যবহৃত হয়। এসব নৌকা বিক্রি হয় ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। জেলার বিভিন্ন এলাকায় বালু উত্তোলন ও পরিবহনে ব্যবহৃত হয় বারিক নৌকা। এই নৌকা লম্বাটে ধরনের হয়। দাম ১৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। নৌকাবাইচে যেসব নৌকা লাগে, সেগুলো তৈরি করতে হয় বিশেষ কায়দায়, খরচও পড়ে বেশি।
জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনাবাজারে প্রতি সোমবার নৌকার হাট বসে। এটি জেলার একটি প্রাচীন বাজার। এখানে নৌকার হাটও বসে বহু বছর ধরে। শুধু স্থানীয় লোকজন নন, জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন নৌকা কিনতে আসেন এখানে। সম্প্রতি ওই হাটে গিয়ে বিভিন্ন গ্রামের লোকজনের ভিড় চোখে পড়ে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় সাচনাবাজার-দুর্লভপুর সড়কের বেশ কিছু অংশজুড়ে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে শত শত নৌকা। এখানে সাধ্যের মধ্যে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য পাওয়া যায় নানা মাপের নৌকা। ভাটি অঞ্চলের মানুষ যে কয়টি হাটে নৌকা কেনেন, এর মধ্যে সাচনাবাজার উল্লেখযোগ্য। প্রতি সোমবার শতাধিক নৌকা বিক্রি হয় এই হাটে।
স্থানীয় বাসিন্দা কবির হোসেন বললেন, বর্ষাজুড়েই নৌকা বিক্রি হয়। তবে আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে নৌক বিক্রি হয় বেশি। এ সময় নৌকার হাটে ভিড় লেগেই থাকে। নৌকা তৈরির কারিগরেরাও দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করেন।
জামালগঞ্জ উপজেলার শেরমস্তপুর, নজাতপুরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের মানুষ নৌকা তৈরি করেন। নৌকা তৈরির কারিগর মো. সহীদ মিয়া, সুরত আলী ও আবদুল গফুর জানান, তাঁরা বর্ষা মৌসুমের অপেক্ষায় থাকেন। এর আগেই কাঠ সংগ্রহ করেন। এপ্রিলে হাওরের বোরো ধান গোলায় তুলে নৌকা তৈরির প্রস্তুতি শুরু করেন। একেকটি আলং (যেখানে নৌকা তৈরি হয়) থেকে সপ্তাহে তিন থেকে চারটি নৌকা তৈরি করেন। একেকটি আলংয়ে চার থেকে পাঁচজন কারিগর থাকেন। তবে বর্তমানে কাঠ, লোহা ও অন্যান্য সরঞ্জামের দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌকা তৈরিতে খরচ বেড়েছে।
নৌকা তৈরির কারিগর আবদুল গফুর বলেন, কাঠের ওপর নৌকার দাম নির্ভর করে। ভালো কাঠ হলে ভালো দাম পাওয়া যায় নৌকার।
হাটে নৌকা কিনতে আসা বেহেলী ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের জয়ন্ত দাস বলেন, তাঁদের গ্রামটি খুবই নিচু। সামান্য বর্ষাতেই রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়। বর্ষার সময় একমাত্র বাহন হচ্ছে নৌকা। পানি বেড়ে সব রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতে নৌকা ছাড়া উপায় নেই। তাই সাচনাবাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় ১২ হাত লম্বা একটি নৌকা কিনেছেন তিনি। জয়ন্ত দাস বলেন, বর্ষায় নৌকা লাগবেই। যতই সড়ক হোক। হাওর এলাকায় নৌকার কদর ফুরাবে না।
নৌকাঘাটের ইজারাদার সামছু মিয়া বলেন, উপজেলার সব কটি ইউনিয়নে বর্ষা এলেই সড়কে পানি উঠে যায়। তাই নিত্যদিনের যাতায়াতব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন হয় নৌকার। এ ছাড়া হাওরে মাছ ধরতে হলেও নৌকা দরকার।
সাচনাবাজার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মাসুক মিয়া বলেন, এখানকার নৌকার হাট ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। তাঁর জন্মের পর থেকে এই নৌকার হাট দেখে আসছেন। এই হাটের সুনাম আছে জেলাজুড়ে। এই হাট ছাড়াও জেলা সদরের ধোপাখালী নৌকাঘাট, শান্তিগঞ্জের আক্তাপাড়া, মধ্যনগরের নৌকাহাট ও ছাতকের জাউয়াবাজারের নৌকাহাট সবার কাছে পরিচিত।